ঈশ্বরকে অন্য কোথাও খুঁজো না। খোঁজো এই মানবদেহে। তবেই তুমি তাকে পাবে, উপলব্ধি করতে পারবে। চিনতে পারবে নিজেকেও। গানের ভিতর দিয়ে আবহমান কাল ধরে এই মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছেন বাউল ফকিররা। সারা বিশ্ব যখন বিভিন্ন রকম বিভাজনের দ্বারা আক্রান্ত, যেমন অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত, তখন বাউল ফকিরদের সহজ তন্ত্র বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিচ্ছে শান্তির বার্তা। এই গানের শক্তিকে বহুদিন আগেই আবিষ্কার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর অনেক গান বাউল গানের দ্বারা প্রভাবিত। সহজ কথা, মন ছোঁয়া সুর, সঙ্গে একতারা, দোতারা, ঢোল, খঞ্জনি, বাঁশি ডুবকির বোলে মজেছে সারা বিশ্ব। মূলধারার মিউজিকও এখন কুর্নিশ করে জায়গা দিচ্ছে বাউল-ফকির গানকে। এই গানের শিল্পীরা প্রান্তিক মানুষ। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে থাকেন এরা। মূলত বীরভূম, বর্দ্ধমান, বাঁকুড়া, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ জেলায় বাউল-ফকিরদের বাস।
Bengali versionসেই অর্থে বাউলদের কোনো নির্দিষ্ট পোশাক বা পোশাকবিধি নেই।কিন্ত কুষ্টিয়া, মুর্শিদাবাদ এবং নদীয়াতে সাদা এবং কালো আলখাল্লার ব্যবহার বেশি দেখা যায়। এঁদের অনেকে আবার নানা রঙের কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরি রঙিন আলখাল্লা ব্যবহার করেন। মুর্শিদাবাদের ফকিররা অনেক সময়েই পরেন সাদা বা কালো আলখাল্লা। বীরভূম, বাঁকুড়া ও বর্ধমানের বাউলরা পরেন গেরুয়া রঙের আলখাল্লা। মহিলা বাউলরা অনেক সময় বা গেরুয়া শাড়ি পরেন।
বাউল গানের অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয় ঐতিহাসিক ও আঞ্চলিক বৈচিত্রপূর্ণ নানা ধরণের বাদ্যযন্ত্র। এর মধ্যে রয়েছে একতারা, দোতারা, ডুবকি, ঢোল, খঞ্জনি, করতাল, বাঁশি, খমক, গাবগুবি ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ শেষের বাদ্যযন্ত্রটির নাম দিয়েছিলেন আনন্দলহরী। অঞ্চল ভেদে এসব যন্ত্র ব্যবহারের বৈচিত্র্য রয়েছে। যেমন, খমক ব্যবহৃত হয় মূলত বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমানে। ডুগি-তবলার ব্যবহার বীরভূম ও বর্ধমান জেলাতেই বেশি দেখা যায়। বাংলা কাওয়ালি গান পরিবেশনের ক্ষেত্রে মুর্শিদাবাদ ও নদীয়া জেলায় হারমোনিয়াম ও ডুগি-তবলা ব্যবহারের চল আছে।
অনুষ্ঠানের জন্য বাউলরা টাকা অথবা উপহার বা থাকা খাওয়া ইত্যাদি পরিষেবা নেন। এর সঙ্গে যুক্ত ঐতিহ্যবাহী বিষয়গুলি হল : মাধুকরী, সাধুসেবা । মাধুকরী বহু প্রাচীন এক প্রথা। কথাটার আক্ষরিক অর্থ মধু আহরণ। প্রাচীন বৌদ্ধ এবং জৈন শ্রমণরা এবং বৈষ্ণবদের কিছু উপ-সম্প্রদায়ের মানুষরা এই রীতি মানতেন। এর থেকেই হয়তো বাউলরা গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষা করার ব্যাপারটা নিয়েছিলেন। এক বা একাধিক ভক্তের উদ্যোগে আয়োজিত সাধুসেবা ও মহোৎসবে বহু বাউল এক হয়ে গান করেন, তত্ত্ব আলোচনা করেন।
বাউল দর্শন (আত্মানুসন্ধান ও জাগতিক আকাঙ্খা থেকে মুক্তি) প্রচারিত হয় গান এবং আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, ভক্তিতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, নবীতত্ত্ব, গৌরতত্ত্ব ইত্যাদি তত্ত্বের মাধ্যমে। বাউল দর্শন এই উপমহাদেশে মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনেরই ফসল। তাই এর মূলে আছে প্রেমধর্মের উদযাপন, বর্ণ, ধর্ম, জাতি, শ্রেণির ভেদ মুছে ফেলার ডাক। এই দর্শনের মধ্যে আমরা শুধু বৌদ্ধ, বৈষ্ণব এবং ইসলাম ধর্মের মিলনই নয়, বাংলার তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষদের ভাবনা ও বিচারের নানা দিক দেখতে পাই।
আখড়া নির্ভর শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বাউলদের গুরু শিষ্য পরম্পরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে। বাউল গুরুরা তাঁদের দর্শন ও সংগীত শিক্ষা প্রসারের কাজ চালান এইসব আখড়া থেকে। আখড়া হল ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান ও বাউল-ফকিরি তত্ত্ব শেখার জায়গা। ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীদের গুরুরা মন্ত্র দেন এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুনরা গুরুর শিষ্য হয়। বাউল মতাদর্শ দর্শন ও গান সহ একটা জ্ঞান পদ্ধতি হলেও মৌখিকভাবে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে প্রবাহিত হয়। এটা পারিবারিকভাবে ছড়ায় না, শুধুমাত্র আখড়ার মাধ্যমে গুরু শিষ্য পরম্পরার মধ্যে দিয়েই বিস্তার লাভ করে।
মহাজনদের রচিত পদ বা গানগুলির সাধারণ অর্থের পাশাপাশি একটা অন্তর্নিহিত অর্থও রয়েছে। সাধারণভাবে মহাজন অর্থে যিনি টাকা ধার দেন, কিন্ত বাউল-ফকিররা গীতিকার বা পদকর্তাকে বলেন মহৎ যে জন অর্থাৎ মহাজন। কারণ মহাজনদের টাকা ধার দেওয়ার মতই এই পদকর্তারাও তাঁদের রচনা ধার দেন। তাঁদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ স্বরচিত গানের পদ। এই পদগুলির নানা স্তরের অর্থ রয়েছে। পদের ওপরকার অর্থটা সাধারণ শ্রোতাদের জন্য। অন্যদিকে এর অন্তঃস্থলে রয়েছে দীক্ষিত শিষ্যদের আত্ম-উপলদ্ধির জন্য মূল দার্শনিক তত্ত্ব, গুরু আশ্রিত হলে তাঁর কাছ থেকে শিষ্যরা এই তত্ত্ব পেয়ে থাকেন।
মহাজনদের লেখা নানা পদ বহু বাউল নানা উপভাষায় গেয়ে থাকে। এই উপমহাদেশের পূর্ব প্রান্তের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বাউল ঐতিহ্য প্রচলিত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বারেন্দ্র ও রাঢ় অঞ্চলে বিশেষত গঙ্গার দক্ষিণ দিকের নদীয়া, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলাগুলিতে, বাউল প্রভাব রয়েছে। এই এলাকাগুলি থেকে অনেক বিখ্যাত পদকর্তা উঠে এসেছেন। বাংলার নানা উপভাষায় গান লিখেছেন তাঁরা। যাঁরা এই গানগুলি গেয়ে থাকেন তাঁরাও তা স্থানীয় ভাষাতেই পরিবেশন করেন। কারণ এই উপভাষাতেই কথা বলেন তাঁরা। এর ফলে গানগুলিতে একটা বৃহত্তর ভাষাগত বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে।
নানা অঞ্চলে প্রচলিত জনপ্রিয় সুরগুলির বৈচিত্র্য বাউল সুরকেও প্রভাবিত করেছে। বাংলার বিস্তীর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চল জুড়েই বাউল গায়কদের দেখা যায়। এখানে অসংখ্য অন্যান্য লোকগানেরও চল রয়েছে। বিশেষ করে ঝুমুর, ভাটিয়ালি, কীর্তন গানের প্রভাব বাউল গানে লক্ষ্য করি আমরা। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গানের কথা ও সুর বদলে যায়, নিজেদের সাংস্কৃতিক শিক্ষা অনুযায়ীই গান পরিবেশন করেন স্থানীয় বাউলরা। যেমন লালন ফকির বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় বসে যে গান লিখেছিলেন সে গানই পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া বা বীরভূমের একজন বাউল ভিন্নভাবে পরিবেশন করতে পারেন।